ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
আপডেট : ২৬ এপ্রিল, ২০২১ ১২:২২

চলে গেলেও ক্ষত রয়ে যাবে করোনার

অনলাইন ডেস্ক
চলে গেলেও ক্ষত রয়ে যাবে করোনার

করোনা থেকে সেরে ওঠা রোগীর দেহে যেমন এর লক্ষণগুলো স্থায়ীভাবে থেকে যায়, বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকমই ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মহামারি সৃষ্ট দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন দেশ এরই মধ্যে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে। ভ্যাকসিন উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে উদ্যোগ দেখা গেছে, তা নজিরবিহীন। আশা করা যায়, এর ফলে প্রত্যাশিত সময়ের আগেই করোনার ক্ষত কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু যে ক্ষত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না তা হলো সামাজিক ক্ষত।

করোনার ফলে বিশ্ব জুড়ে অর্থনীতির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পর্যটনের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোও। বিপুল সংখ্যক মানুষের চাকরি হারানো, যুদ্ধকালীন সময়ের মতো ঋণ গ্রহণ এবং ধনী-দরিদ্র ও অন্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক বৈষম্য যে পরিমাণ বেড়েছে, সে ক্ষতগুলো কাটিয়ে ওঠা মোটেই সহজ হবে না। দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই মূলত এসব সমস্যা সামাল দিতে হবে।

‘এটা খুবই স্বাভাবিক যে, বিপর্যয়কর একটি সময় পার করার পর সবকিছু দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসে না’, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ভেলোরি আর্থি এ কথা বলেছেন। তিনি স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবস্থার ওপর সংকটকালীন অবস্থার প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রমাণিত এ ধরনের বড় দুর্যোগের রেশ দশকের পর দশক রয়ে যায়। গত এক বছরে প্রায় সব দেশেই জিডিপির পরিমাণ কমেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৩০ এর মহামন্দার পর বৈশ্বিক জিডিপি আর কখনোই এতটা নিম্নগামী হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশনের (আইএলও) হিসাব মতে, এই ক্ষতির পরিমাণ ২৫ কোটি ৫০ লাখ মানুষের পূর্ণকালীন চাকরি হারানোর সমান।


পিউ রিসার্চের গবেষকরা বলছেন, ১৯৯০ সালের পর বৈশ্বিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি এতটা সংকুচিত আর হয়নি। মহামারির ফলে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির পরিমাণ সমান নয়। দুর্যোগ কেটে গেলে এই ক্ষত সেরে সবগুলো দেশ সমান দক্ষতার পরিচয় দেবে না। স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে করোনার ছোবল কাটিয়ে উঠতে বহু বছর লেগে যাবে। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কারমান রেইনহার্ট বলেন, কোভিড-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যাওয়া একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। কোনো কোনো দেশের জন্য এর জন্য যুগ যুগ সময় লেগে যেতে পারে। কারণ কোভিডের ফলে সবগুলো দেশ সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বর্তমান পরিস্থিতিকে ২০০৮ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের অনেকটা বিপরীত অবস্থা মনে করছে। ঐ সংকটে মূলত ধনী দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তখন মার্কিন ব্যাংকগুলোর ঋণ সংকট ধনী অর্থনীতিগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বর্তমান সংকট ধনী-গরিব সব দেশকে স্পর্শ করলেও এর প্রভাব সব দেশের ওপর সমানভাবে পড়েনি। ধনী দেশগুলো নিজস্ব সক্ষমতাবলে যত দ্রুত এর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারবে গরিব দেশগুলো সেটা পারবে না।


বিশ্বব্যাংক চলতি বছর জানুয়ারিতে এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, এখনই উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে বৈশ্বিক প্রবৃৃদ্ধির গতি হবে অসম। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি মহামারি পূর্বকালীন অবস্থার চেয়ে ৫ শতাংশ কম হতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, চলতি দশকে সার্বিক প্রবৃদ্ধি ২০১০ এর দশকের তুলনায় ২ শতাংশ কম এবং ২০০০ সালের প্রথম দশকের তুলনায় এটি ৩.৩ শতাংশ কম হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ঠিক সময়ে ঠিক পরিকল্পনা না নেওয়ার জন্য একটি দশকের জন্য পিছিয়ে যেতে পারে বিশ্ব। তারা বলছেন, যে কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগের সময় কেবলমাত্র এর আর্থিক দিক বিবেচনা না করে জলবায়ু পরিবর্তন ও কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর ওপরও জোর দিতে হবে।

বিশেষ করে কর্মীদের নতুন বিষয়ে দক্ষ করে তোলা মহামারি-পরবর্তী সময়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মহামারির সময় অনেক কর্মক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অনেক কর্মী তাদের সাবেক কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে পারবে না, তাদের নতুন কাজের দক্ষতা অর্জন করতে হবেই। নীতিনির্ধারক মহলকে একসঙ্গে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে বলে মনে করেন সিটিগ্রুপ ইনকরপোরেশনের চিফ ইকনোমিস্ট ক্যাথেরিন মান। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাঁচাতে প্রণোদনা কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত। তবে শুধু প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটানো যাবে না। উদ্ভাবন ও উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি না দিলে ভেস্তে যেতে পারে প্রণোদনা কর্মসূচি।

উপরে